শান্তিনিকেতনে ছাত্র তথা বিংশ শতকের শিল্পী বিনোদবিহারী মুখার্জি যেমন শিল্পের টানে ছুটে গেছেন নেপালে, ১৯৪৯-৫২ সাল পর্যন্ত নেপালে থাকাকালীন কাঠমাণ্ডুর পশুপতিনাথ মন্দিরের পাশাপাশি সাক্ষী থেকেছেন সেদেশের শিল্পকর্মের, তেমনই নেপালের বিখ্যাত লেখক লেখনাথ পাওডায়াল উচ্চশিক্ষার টানে এসেছেন আমাদের বেনারসে৷ নেপাল ভারতের সম্পর্কের পারদ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উঠানামা করলেও সাহিত্যের মূল স্রোত থেকে কেউ সরে যায়নি৷বরং নেপালের সাহিত্যে ভারতের সম্পর্ক রয়েছে৷ সিকিম রাজ্যে জন্মগ্রহণ করলেও তুলসিরাম শর্মা নেপালি ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন৷ তাঁর গভীর দার্শনিক চিন্তার দলিল হয়ে রয়েছে তাঁর ‘আম আজা কো সিকিম’, ‘জন্মভূমি’ -এর মতো লেখা৷
ভারতের ইংরেজি সাহিত্যের বিকাশে আর কে নারায়ণ, রাজা রাও, মূলক রাজ আনন্দ যদি তিন মহারথী হন, তবে নেপাল সাহিত্যের বিকাশে রয়েছে তিন মহান ব্যক্তি – লেখ নাথ পাওডায়াল, লক্ষ্মী প্রসাদ দেবকটা আর বাল কৃষ্ণ শামা৷ নেপাল সাহিত্য মূলত ভাষা, ধর্ম, আর নাগরিক অধিকার নিয়েই গড়ে উঠেছে৷ আসলে সময় পরিস্থিতি যখন যেভাবে গেছে সাহিত্যেও তার তেমন প্রভাব ফেলেছে৷ বাংলায় রবীন্দ্রনাথ যেমন একটা অধ্যায়, নেপালের কবি ভানু ভক্ত সেই রকমই একটা যুগ হয়ে রয়ে গিয়েছেন৷ তাঁকে নেপালের প্রথম কবি বলা হয়৷ তিনি রামায়ণকে নেপালি ভাষায় অনুবাদ করেন৷ তিনিও বেনারস আসেন সংস্কৃত ভাষার টানে৷ উল্লেখ্য, বাংলা সাহিত্যের মতো নেপালের সাহিত্যেও বিবর্তন রয়েছে৷ প্রাক ভানুভক্ত যুগে ছিল উচ্চ শ্রেণীর আর সংস্কৃত ভাষায় প্রাধান্য৷ পরে অবশ্য পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে৷ নেপালে সাহিত্যে মিশে গিয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ ধর্ম৷
১৯৫০ সালে রানা শাসকরা চিনের ভয়ে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়, যদিও ১৯৬২ সালে ভারত চিন যুদ্দের পরে সে সম্পর্কের অবনতি হয়৷ এরপর থেকে সম্পর্ক কখনও শীতল, কখনও স্থিতিশীল থেকেছে৷ ১৯৯০ সালে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কৃষ্ণ প্রসাদ ভাট্টাই ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং চুক্তি স্বাক্ষর করেন৷
নেপাল অস্থির ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে৷ ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সে দেশ দেখেছে গৃহযুদ্ধ৷ পরবর্তী সময়ে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণ প্রজাতন্ত্রী নেপাল গড়ে উঠেছে৷ সংস্কৃত শব্দ নেপালায়ার অর্থ পর্বতের পাদদেশ৷ তিব্বতীয় শব্দ নিয়ামপল শব্দের অর্থ পবিত্র ভূমি৷ লেপচাদের কাছে নেপাল পবিত্র গুহা৷ মনে করা হয়, থেরাস, মিশ্র দ্রাবিড় লোকেরা নেপালের কেন্দ্রীয় তরাই অঞ্চলে বসবাস করত৷ কিছু পণ্ডিত অনুমান করেন, তিব্বত থেকে লোক এসে উত্তর নেপালে বসবাস শুরু করে৷ ঐতিহাসিক তথ্যের বিতর্ক থাকলেও এটা সত্য যে, নেপালের জনজীবনে লুকিয়ে রয়েছে বৈচিত্র্য৷ নেপালের ইতিহাসে রয়েছে লিচ্ছবি, সিমরুন, ঠাকুর বংশ৷ নেপালে পৃথ্বী নারায়ণ শাহ গোর্খা রাজ্য গঠন করেন৷ ১৮১৬ সালে সৌগলির সন্ধি সরিয়ে ব্রিটেন নেপালের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন হয়৷ ১৯৫০ সালে রানা শাসকরা চিনের ভয়ে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়, যদিও ১৯৬২ সালে ভারত চিন যুদ্দের পরে সে সম্পর্কের অবনতি হয়৷ এরপর থেকে সম্পর্ক কখনও শীতল, কখনও স্থিতিশীল থেকেছে৷ ১৯৯০ সালে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কৃষ্ণ প্রসাদ ভাট্টাই ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিং চুক্তি স্বাক্ষর করেন৷ রাজা জ্ঞানেন্দ্রর সময় সম্পর্কের আবার অবনতি হয়৷ ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেপাল যান৷ এসব রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি বাদ দেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে দুই দেশের জীবনে কাঁটাতারের গল্প নেই৷ মানুষের জীবন এই ভেবে প্রবাহিত হচ্ছে— আমরা এক৷ বিশেষ করে মনিরাম ভট্ট, বিশ্বেশ্বর প্রসাদ কৈরালা, দীনবন্ধু শর্মা, সুমন পখবেলের লেখা পড়লে তাই মনে হয়৷
নেপালের ভাষা সংস্কৃতির উপর প্রথম যে মানুষটি সক্রিয় হোন তিনি লেখ নাথ পাওডায়াল৷ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যকে যেমন মনে করতেন তিনি তেমন মনে করেন৷ তাঁর কাছে, সাহিত্য সমাজের দর্পণ৷ পাওডায়াল মনে করতেন, “আমার কবিতা, নাটক সমাজ সংশোধনের কাজে ব্যবহার হোক৷” তিনি দর্শন অপেক্ষা ভাষাতে বেশি জোর দেন৷ তিনি বাঁধা সমাধান শ্লোক রচনা করতেন, যার প্রধান বিষয় সমাজ, রাজনীতি৷ কাঠমাণ্ডুতে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি আসেন বেনারসে৷ স্ত্রী মারা যাবার পরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, সঙ্গে আর্থিক সমস্যা৷ লেখ নাথ পাওডায়াল ভারতে আসেন কাজের জন্য৷ পরে নেপালে ফিরে যান এবং কাঠমাণ্ডুর পণ্ডিত রাম মণি দীক্ষিতের পরিবারের ছেলেদের পড়ানোর কাজ পান৷ ১৯৫১ সালে রাজা ত্রিভুবন তাঁকে কবি শিরোমণি উপাধি দেন৷ তিনি তাঁর লেখায় শাসকদের সমালোচনাও করেছেন৷ পাওডায়ালকে কালিদাসের ‘ঋতুসংহার’ গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে৷ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী পাওডায়াল চিন্তার সাধক৷ তিনি ডুব দেন চেতনার সন্ধানে৷ তাঁর ‘পিঞ্জডাকা সুগা’ লেখাতে তিনি দেহের মধ্যে খুঁজেছেন চেতনার অবস্থান৷ গান্ধীজির মৃত্যুতে তিনি শোকাহত হন, যার প্রতিফলন ঘটে তাঁর ‘জ্যোতিকা সত্য’ লেখায়৷
পাওডায়াল যেখানে শেষ করেছেন হয়তো বালকৃষ্ণ শামা সেখান থেকেই শুরু করেছেন৷ তিনি যখন সাহিত্যে আসছেন চারপাশ তখন অনেকটা আধুনিক৷ নাট্য শিরোমণি বালকৃষ্ণকে নেপালের শেক্সপিয়ার বলা হয়৷ উত্তরাখণ্ডের দেরাদুনে তিনি আর্মি ট্রেনিং করেন৷ তাঁর লেখায় আবেগ, বিষাদ, ভালবাসার মধ্যে মিশে রয়েছে একাকীত্বের গল্প৷ তিনি একা থাকতে ভালোবাসতেন৷ তাঁর নাটক ভাটের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে৷ অন্যদিকে প্রেম পিণ্ডা, বুহার্টান লেখাতে তিনি ভিন্ন রূপে ধরা দেন৷ তাঁর চিন্তায় মিশে রয়েছে এলিয়ট, ব্রেখেট৷
নেপালের আর্থিক অবস্থাকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন লক্ষ্মী প্রসাদ দেবকটা৷ তাঁর শকুন্তলা, সুলোচন, মুমা মদন পড়লে বোঝা যায় তিনি সামাজিক জীবনের সমান্তরালে প্রকট করতে চেয়েছেন অর্থনীতিকে৷ তিনি মনে করতেন, মানুষ তাঁর মনের জন্যই মহান৷ জাতপাত বর্ণ ধর্ম কাউকে মহান করতে পারে না৷ তাই মানুষকে ভালোবাসতেন৷ তিনি বলতেন, মানুষের সঙ্গে না মিশলে মানুষ চেনা যায় না৷ ভাষার প্রতি বিশেষ করে সংস্কৃত ভাষায় তাঁর আগ্রহ ছিল৷ তবে তাঁর জীবন সুখকর হয়নি৷ নার্ভের সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন৷ জীবনে বেঁচে থাকার চেয়ে তিনি মৃত্যুকে আপন করতে চেয়েছেন৷
নিজের স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘শোবার সময় এই পৃথিবী ত্যাগ করি, হয় পটাসিয়াম সায়ানাইড বা মরফিন কিছু খেয়ে৷’ একসময় তাঁর মানসিক অবস্থা এতটাই খারাপ হয় যে, ১৯৩৯ সালে তাঁকে রাঁচি আনা হয় চিকিৎসা করার জন্য৷
অন্যদিকে, নস্ট্যালজিক আমন্ত্রণের বার্তা দেন কবি কোমল মাল্লা৷ তিনি লেখেন, ‘এসো একবার, ঘুরে যাও গৌতম বুদ্ধের দেশ৷’ রাজনীতির বিভাজন সরিয়ে প্রকট হয়েছে ভালবাসা, বন্ধুত্ব, যার প্রতীক হয়ে উঠেছে কবি সুরেশ শাহের ‘নেপাল তোমাকে ডাকছে’ কবিতায়৷ হয়তো তাই কাঁটাতারের সীমান্তে দাঁড়িয়ে মানুষের গলা ভারী হয়ে আসে, আবেগ শুধু একটাই প্রশ্ন করে, ‘যদি বিভাজন না থাকতো…?’